এই প্রতিবেদনটি আদতে বাংলাতেই লেখা হয়েছিল। সারা ভারত জুড়ে পারি এডুকেশন নিজ নিজ মাতৃভাষায় লিখতে ও সাংবাদিকতায় উৎসাহী অসংখ্য পড়ুয়া, গবেষক এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কাজ করছে।

আমার বাবা শঙ্কর মণ্ডল আর ঠাকুরদা সন্তোষ মণ্ডল দুজনেই মৎস্যচাষি, বাড়ির কাছেই তিনটে পুকুর আছে আমাদের, হরেক রকমের মাছ চাষ হয় সেখানে।

খেয়াদহের কাছেই বেলেখালি নামে একটি ছোট্ট গ্রাম আছে, সেখানেই থাকি আমি। ঠাকুরদা সন্তোষ মণ্ডলকে আমি দাদু বলে ডাকি, মানুষটা ছোটবেলায় চাল বিক্রি করে পেট চালাতেন, থাকতেন বেলেখালির কাছেই দিওয়াড়া নামে আরেকটা ছোট্ট গাঁয়ে। তিরিশের কোঠায় পা রেখেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন দাদু, আর ছিল আমার দিদা দেবোলা মণ্ডল (এখন ৬৬ বছর বয়স তাঁর)। বেলেখালিতে এখন যে ছোট্ট ৭ ফুট বাই ১০ ফুটের মাটির কুঁড়েঘরে আমরা থাকি, জমিজমা কিনে দাদুই বানিয়েছিলেন সেটা। আমরা পৌণ্ড্র (তফসিলি জাতি হিসেবে চিহ্নিত এ রাজ্যে) জাতির মানুষ।

বাড়ির কাছেই তিনটে কৃত্রিম পুকুর ছিল বেলেখালিতে, মাছ চাষ করবেন বলে সেগুলো কিনে নেন দাদু। বাবা বড় হলে সেই ব্যবসার ভার এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। সেদিন থেকে আজ অবধি আমার মা বৈশাখী মণ্ডলের সঙ্গে ব্যবসাটার দেখভাল করেন আমার বাবাই।

সুন্দরবনের ঠিক গা ঘেঁষেই, বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে ঢাকা কলকাতার পূর্বাঞ্চল – ১২,৫০০ হেক্টর জুড়ে অসংখ্য পুকুর, ডোবা, ভেড়িতে চাষ করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, বিক্রি হয় হাটে-বাজারে। ২৫৪টি ভেড়ি আছে এখানে। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি (ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডস্ বা ইকেডাব্লিউ) হিসেবে চিহ্নিত এই অঞ্চলটি দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত। বর্জ্য জলে পুষ্ট এই জলজ-পালন (অ্যাকোয়াকালচার) এলাকাটি একাধারে মৎস্যচাষি, মৎস্যজীবী ও চাষিদের কর্মক্ষেত্র ও নিবাস। বিবিধ প্রজাতির পশুপাখি ও গাছপালায় ভরা এ অঞ্চলটিতে অনেক ধরনের জলচর পাখিও দেখতে পাওয়া যায়।

খানিক সময় বাদে বাদে বর্জ্য-খাল থেকে খানিকটা করে জল ছাড়া হয় ভেড়িগুলোয়, বর্জ্য জল মাছ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়। অবশ্য মাছ চাষের আগে মৎস্যজীবীরা তাতে বেশ করে চুন মিশিয়ে নেন।

আমার বাবা শঙ্কর মণ্ডল একজন মৎস্যজীবী। মাছ চাষ করা, তারপর সেগুলো বড় হলে ধরে কাছেই বানতলার হাটে গিয়ে বিক্রি করা, এসব বাবাই করেন। তবে একসাথে অনেকগুলো মাছ ধরতে হলে আড়জাল ছাড়া উপায় নেই – তখন কাছেপিঠের গ্রামগুলো থেকে জেলেদের দিনমজুরি খাটতে ডেকে পাঠান বাবা।

বাবার দিন শুরু হয় ভোর ৪টের সময়। বাড়ির সামনে দিয়েই চলে গেছে খেয়াদহের সড়ক, সেখানেই খানিক হেঁটে আসে মানুষটা। ততক্ষণে মা-ও উঠে পড়েন। বাবা এসে কি এসেই মুখ ধুয়ে মায়ের হাতে বানানো চা-টা খেয়ে বেরিয়ে পড়েন পুকুরের পানে, মাছের তদারকি করতে হবে যে।

৭২ বছরের দাদু আর ৬৬ বছরের দিদার দেখভাল করা থেকে রান্নাবান্না আর সংসারের হাজারো কাজ একাহাতে সামলান আমার মা, ৩২ বছর বয়স তাঁর। গমের দানা ভিজিয়ে, তারপর গেঁজিয়ে মাছের খাবার বানানো, মাছ ধরার সাজ-সরঞ্জাম পরিষ্কার করা, পুকুরের পাড়গুলোর সাফ-সাফাই, হেঁশেলের ফাঁকে ফাঁকে এসবও আমার মা-ই করেন।

দুপুর হলেই দেখি বাবা কেমন করে মাছগুলোকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। বাজারে বেচার জন্য যেসব মাছ ধরা হয়, সেগুলো একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে ভরে সেটা আচ্ছাসে বেঁধে নেন সাইকেলের পিছনে। ব্যাস, এবার লক্ষ্য তিন কিলোমিটার দূরে বানতলার হাট। মাঝেসাঝে বাড়ির জন্যও মাছ ধরে আনেন বাবা, মা তখন বেশ জুত করে তেলাপিয়ার ঝোল, শোল মাছের কালিয়া, পাবদা মাছের ঝাল, কত কী যে রাঁধেন তার ঠিক-ঠিকানা নেই।

বাড়ির পাশেই একটি ছোট্ট সবজি বাগান আছে আমাদের, ১৫ বাই ২০ ফুটের। গাছগাছালির ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান আমার মায়ের, যত্ন করে কলা, আম, লিচু, কাঁঠাল, কাগজি লেবু, নিম, নারকেল, পেঁপে, হরেক কিসিমের তরিতরকারি, লাউ-কুমড়ো, তুলসি না জানি আরও কত কিছু লাগিয়েছেন সেই বাগানে। এছাড়া টমেটো আর লঙ্কা তো রয়েইছে। এইতো, কদিন আগেই বাঁশের বাখারি কেটে শশাগাছের জন্য মাচা বেঁধেছেন বাবা।

এসবের পাশে পাশে জবা আর সন্ধ্যামণিও (মিরাবিলিস জালাপা) ফুটেছে। বাড়ির আশেপাশে অনেক ধরনের পাখি দেখতে পাওয়া যায় – বক, পানকৌড়ি, সবাই মাছ খেতে আসে আমাদের পুকুরে। কাক, কোয়েল, চড়ুই, টিয়া, এনারাও দেখা দেন থেকে থেকে।

যে পুকুরটায় মাছ চাষ করা হয়, বেলা ১১টা বাজলে মাছেদের মুড়ি বা ভিজিয়ে রাখা গম খাওয়াতে ফিরে আসেন বাবা। তারপর ওই পুকুরেই একটা ডুবকি মেরে বাড়ি এসে ভাতঘুম দেন খানিক, ঘুম ভাঙলে বেরিয়ে পড়েন আবারও। এবার পালা পুকুর পাহারা দেওয়ার, যাতে মাছরাঙা বা বক এসে মাছ না খেয়ে যায়।

ওদের হাত থেকে মাছগুলোকে বাঁচাতে সে এক আজব যন্তর বানিয়েছেন বাবা – পুকুরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে টাঙানো একটা দড়ি, তাতে কাঠের একটা পাটাতন বাঁধা, সেটায় আবার উল্টো করে আটকানো রয়েছে পুরোনো একখানা ক্যানেস্তারা। দড়িতে টান পড়লেই বিকট শব্দ করে বেজে ওঠে টিন, ঘাবড়ে গিয়ে উড়ে পালায় পাখির দল।

মাছচাষের ওই পুকুরটার ধারে কখনও কেমনও মাঝরাত্তিরেরও হাঁটতে যান বাবা। “চোর আসে তো মাছ চুরি করতে, আর সে ব্যাটারা মাঝরাত্তির না হলে ইদিকে পা বাড়ায় না। মাছগুলো চুরি হয়ে গেলে অথই জলে ডুবে যাবো, তাই এতটা তক্কে তক্কে থাকি,” বলেছিলেন বাবা।

তবে এবছর এমন খ্যাপার মতো বৃষ্টি হল যে আর্ধেক মাছ পুকুর টপকে খালের জলে ভেসে গে’ল, বাকি খানিক বিক্রি করার আগেই নষ্ট হয়ে গে’ল পচে। বড্ডো টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এ বছরটা।

সোনারপুর ব্লকের খেয়াদহের কাছেই বেলেখালি জনপদে তাঁদের বাড়ির কাছেই তিন-তিনটে পুকুরে হরেক রকমের মাছ চাষ করেন শঙ্কর ও সন্তোষ মণ্ডল। ফটো: রূপসা মণ্ডলের তোলা
ভেড়িতে খাবলা জাল ফেলছেন শঙ্কর মণ্ডল। ফটো: রূপসা মণ্ডলের তোলা
সারাদিন কতটা কী মাছ ধরা হ’ল তা খুঁটিয়ে দেখছেন শঙ্কর। ফটো: রূপসা মণ্ডলের তোলা
জালে ধরা পড়েছে নাইলোটিকা মাছ। ফটো: রূপসা মণ্ডলের তোলা
বেলেখালিতে শঙ্কর ও সন্তোষ মণ্ডলের তিনটি ভেড়ির মধ্যে একটি। ফটো: রূপসা মণ্ডলের তোলা
জল থেকে মাছ-ধরার জাল তুলে আনা হচ্ছে। ফটো: রূপসা মণ্ডলের তোলা

দ্য ডিসাপিয়ারিং ডায়ালগ কালেক্টিভ (ডিডি) নামক সংগঠনটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং তাঁদের মধ্যে থেকে কাজ করে। কথোপকথন যাতে শুরু করা যায়, যাতে নিত্যনতুন আলোচনা উঠে আসে এবং বিবিধ বাধাবিপত্তি যাতে টপকে যাওয়া যায়, সেজন্য শিল্প ও সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসেবে তুলে নিয়েছে ডিডি। বিদ্যমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশের সংরক্ষণে সহায়তা তথা উত্তরোত্তর তাকে সমৃদ্ধ করে তোলাটাই তাদের মূল লক্ষ্য।

এই প্রতিবেদনটি আইএফএ-পারি ফেলোশিপের ছত্রছায়ায় সংকলিত জল-আ-ভূমির গল্প ও কথা | স্টোরিজ অফ দ্য ওয়েটল্যান্ড নামক সংকলনটির একাংশ।

Editor's note

পশ্চিমবঙ্গের খেয়াদহ উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস সেভেনে পড়ে রূপসা মণ্ডল। ফটোগ্রাফের মধ্যে দিয়ে নিজের বাবার দৈনন্দিন জীবন তুলে ধরতে উৎসুক রূপসা ব্যবহার করেছে একটি স্মার্টফোন। তার কথায়: "চারিদিকের পরিবেশ আর বাবার জীবনযাত্রাকে উপভোগ আর তারিফ করতে পেরেছি। তাছাড়া নতুন নতুন জিনিস শেখার এটা একটা সুযোগও ছিল বটে।"

 

 

অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)।

 

 

জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল করেছেন। বর্তমানে অনুবাদ সহায়ক হিসেবে জশুয়া পারি'র সঙ্গে কর্মরত। কবি, শিল্পলেখক, শিল্প সমালোচক তথা সমাজ কর্মী ইত্যাদি নানান ভূমিকায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ।