
“মহারাষ্ট্রের মানুষ মিহি পেষাই করা আটা পছন্দ করেন; গুজরাটিরা মাঝারি পেষাই আটা ভালোবাসেন, আবার পঞ্জাবিরা খানিক মোটা দানার আটা চান,” বলছেন মুম্বইয়ের আটা চাক্কিওয়ালা সূর্য প্রকাশ সিং। তিন দশক ধরে এই ব্যবসায় থাকার সুবাদে সূর্য প্রকাশ সিং যে নিজের ক্রেতাদের স্বাদ খুব ভালোই বোঝেন, সেকথা বলাই বাহুল্য।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে সূর্য প্রকাশ উত্তরপ্রদেশের পিপারি গ্রাম থেকে মুম্বই চলে আসেন, বর্তমানে তাঁর বয়স ৫৩। কাজের খোঁজে প্রথমবার মুম্বই এসেছিলেন। থানে ও ডোম্বিভলির আটা পেষাইয়ের কলগুলিতে সহায়ক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে মুলুন্দে একটি আটা পেষাইয়ের কলে তদারকি শুরু করেন এবং অচিরেই হয়ে ওঠেন চাক্কিওয়ালা। মুম্বই শহরতলির মুলুন্দের একটি ছোটো গলিতে তাঁর আটা চাক্কিটি অবস্থিত, বাইরে একটি বোর্ডে লেখা আছে, ‘কৃষ্ণা আটা কল’। এই আটা চাক্কির ম্যানেজার সূর্য প্রকাশকে প্রায়শই আটার টিনের বাক্স দিয়ে ঘেরা চাকির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর জামা-কাপড়ের মতোই চাকির ভিতরকার ধূসর দেওয়ালগুলোও আটার পরতে মোড়া।
ঘরের ঠিক মাঝবরাবর আছে চাকি-মেশিনটি। এতে একটা ধাতব পাত্রের মধ্যে দুটো পেষাইয়ের পাথর বসানো রয়েছে। মেশিনটির ওপরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ফানেলের মতো একটা বস্তু। এর ঠিক উল্টোদিকে আছে একটা মোটর এবং বেল্ট দিয়ে মোটরের সঙ্গে পেষাই করার পাথর দুটি সংযুক্ত করা আছে।
সূর্য যে মুহূর্তে মোটর চালু করেন, বেল্ট দিয়ে মোটরের শক্তি পেষাইয়ের জোড়া পাথরে পৌঁছায়, আর পাথরের গ্রাইন্ডার দুটি ঘুরতে আরম্ভ করে। উপরের ফানেলটি দিয়ে গম ঢালা হয়, এবং মেশিনের নিচে রাখা একটা পাত্রে পেষাই করা আটা সংগ্রহ করা হয়। গ্রাহকেরা মূলত একসঙ্গে অনেকটা পরিমাণে গম কেনেন। এই গম তাঁরা হাত চালিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে নেন। তারপর এই গমই ‘কৃষ্ণা আটা চাকি’-র মতো স্থানীয় চাকিগুলিতে পেষাই করা হয়।





বাঁদিক এবং মাঝখানে: সূর্য গমের দানাগুলোকে ফানেলে ঢালছেন। এখান থেকে দানাগুলো গ্রাইন্ডিং মেশিনে যাবে। ডানদিকে: সূর্য একটি পাত্রে পেষাই করা আটা ভরছেন। চিত্রগ্রাহক: প্রিয়াঙ্কা গুলাটি
সপ্তাহে একবার তিনি মেশিনের বিভিন্ন অংশ খুলে পরিষ্কার করেন। এতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগে।
সূর্যের প্রায় পুরো জীবনটাই চাকিওয়ালার কাজেই অতিবাহিত হয়েছে বটে, কিন্তু তবু তিনি জোর দিয়ে বলেন, “আমি কোনওদিন কাউকে চাকি চালানোর জন্য উৎসাহ দেব না, এতে জীবন চলে না।” প্যাকেটজাত আটা এসে যাওয়ায় আলাদাভাবে গম কিনে পেষাই করা আটার চাহিদা কমেছে। এতে চাকিওয়ালাদের উপার্জনও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ৯০-এর দশকের শেষ দিক পর্যন্ত সূর্য দিনে ১০-১২ ঘণ্টা আটা-কল চালাতেন। বর্তমানে বেশিরভাগ দিনই তিনি চাকি খোলেন বিকাল ৫টা নাগাদ এবং রাত ৮টার মধ্যে সব কাজ শেষ হয়ে যায়। প্রতি মাসে আটার কল থেকে ওর মোটের উপর ১৫,০০০ টাকার মতো উপার্জন হয়।
সূর্যের কথায়, “আগে এক কিলো আটা পিষে মাত্র ১-২ টাকা আয় হত। আগেকার দিনে ৫০০ টাকায় অনেক কিছু কেনা যেত। এখন তো সব জিনিসেরই দাম বেড়ে গেছে।”
বর্তমানে এক কিলো আটার জন্য সূর্য ৭ টাকা নেন। তাছাড়া, অন্যান্য শস্যদানাও পেষাই করেন। এক কিলো চানার ডাল পেষাই করতে ১০ টাকা, এছাড়া জোয়ার ৭ টাকা, বাজরা আর নাচনির মূল্য ৬ টাকা। তবে আটার চাহিদাটাই বেশি।


“যদি কখনও খুচরো পয়সা বা অন্য কোনওরকম ক্ষুদ্র বস্তু শস্যের মধ্যে মিশে থাকে, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে,” সূর্য জানালেন। ছোটো ধারালো বস্তুর কারণেও মেশিনের সঙ্গে সংযুক্ত বেল্টটি ছিঁড়ে যেতে পারে। এতে কাছেপিঠে কেউ থাকলে তার আঘাত লাগতে পারে। সূর্যের নিজের সঙ্গেই একবার এই কাণ্ড ঘটেছিল। মেশিনের একটা অংশ ভেঙে গিয়ে তাঁর চোখের কাছে এসে আঘাত করে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মাথা রক্তে ভরে যায়। কাছেই বাচ্চারা খেলছিল, তারাই ওঁকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু, সেখানকার চিকিৎসার খরচ বইতে পারেননি তিনি। একজন স্থানীয় চিকিৎসক পরবর্তীকালে তাঁর চিকিৎসা করেন। সূর্য সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে বললেন, “ভাগ্যিস, আমি মেশিনের খুব একটা কাছে ছিলাম না। নইলে আমার প্রাণে বাঁচা অসম্ভব ছিল।”
আজ প্রায় ২০ বছর ধরে সূর্য এই আটার কলটা চালাচ্ছেন বটে, তবে এর মালিক তিনি নিজে নন। কত কিলো আটা পেষাই হল, তার ভিত্তিতে আটা কলের মালিক সূর্যের মজুরি নির্ধারণ করেন। চাকি-মেশিনের সঙ্গে একটা মিটারযন্ত্র যুক্ত আছে। এর সাহায্যে চাকির মালিক কত কিলো আটা পেষাই করা হল, তার হিসেব রাখেন। সূর্য বললেন, “৯ কিলো আটা পেষাই করার জন্য আমি ৬৩ টাকা নিই। এর মধ্যে ২০ টাকা আমি নিজের জন্য রাখি, আর বাকিটা যায় মালিকের কাছে।”
গ্রাহকেরা এলে সূর্য অভিবাদন জানিয়ে কথোপকথনে ব্যস্ত রাখেন। এসবের মধ্যেই উনি আটা পিষে পাত্রে ভরে দেন। সূর্য বলছিলেন, “গ্রাহকেরা খুবই বিশ্বস্ত আমার প্রতি। শরীর খারাপ হলে যখন কাজ করতে পারি না, ওঁরা আমার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন। অন্য কোনও চাকিতে যান না।”
তাঁর আটাকলের মতো অন্যান্য স্থানীয় চাকিতেও পাথরের গ্রাইন্ডার দিয়ে শস্যদানা পেষাই করা হয়। এতে খুব ধীর গতিতে এবং অল্প তাপমাত্রায় পেষাই হয়। অন্যদিকে, বড়ো কোনও কারখানার কলে শস্যদানা পেষাই করতে দ্রুত গতির ঘূর্ণনশক্তি ব্যবহার করা হয়, যা অতিরিক্ত তাপ নিষ্কাশন করে আটার পুষ্টি কমিয়ে দেয়। এছাড়াও, প্যাকেটজাত যে কোনও দ্রব্যেই ‘প্রিজারভেটিভস’ অর্থাৎ এমন সংরক্ষক পদার্থ বা রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যাতে তা বেশিদিন ব্যবহারের উপযোগী থাকে।




একজন ক্রেতা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) প্রায় ১০ বছর ধরে সূর্যের কাছে আসছেন। তিনি বললেন, এখানে আসার আগে আজ সকালেই তিনি শস্যদানাগুলোকে পরিষ্কার করেছেন। তাঁর কথায়, “আমাদের প্যাকেটের আটা কেনার সামর্থ্য নেই। তাই আমরা এখানে আসি। ঠিক কেমন আটা আমরা চাই, ও [সূর্য] সেটা ভালোই জানে।” আরেক মহিলা, যিনি দু-বছর ধরে সূর্যের কাছে আসছেন, তিনি বললেন, আগের চাকিওয়ালা বেশি দাম চাওয়ায় তিনি সেখান থেকে সূর্যের আটাকলে চলে এসেছেন। তিনি এই আটাই পছন্দ করেন, কারণ তাঁর মনে হয়, স্থানীয় চাকিতে পেষাই করা আটা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।
স্ত্রী ছায়া এবং তিন সন্তান-সহ মোট পাঁচ সদস্যের পরিবারে উপার্জনের একমাত্র উপায় সূর্যের এই চাকি। তিন সন্তান সালু, অভিষেক এবং অনিকেতের বয়স যথাক্রমে ২৭, ২৩, এবং ২১। ঘর ভাড়া বাবদ ৫,০০০ টাকা লেগে যায়, এবং সংসারের বাকি খরচ চাকি থেকে উপার্জিত টাকা দিয়েই চলে। তাঁর কথায়, আমাদের ঘরখানা এতজনের পক্ষে বড্ড ছোটো বলে আমি রাতে এই আটাকলেই ঘুমাই।” ছেলেরা উপার্জন করতে শুরু করলে তাঁদের সংসারের হাল খানিকটা শোধরাবে বলে সূর্য আশা করেন।
কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়ও সূর্যের উপার্জন বজায় ছিল। তিনি জানালেন, “আমার চাকি খোলাই রেখেছিলাম, কারণ কোনও অনুমতি নিতে হয়নি আমাকে। এই গোটা অঞ্চলে একমাত্র আমার চাকিই খোলা ছিল।”
“খুব বেশি টাকা হাতে আসে না [এই একটা আটার কল থেকে] ঠিকই, তবু অন্য কিছু করার কথা ভাবতেও পারি না। এই আটা চাক্কি, এই মোটর, এই জীবন – এর বেশি আর আমি আর কীই-বা জানি।”
পারি’র হোমপেজ-এ ফিরতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
Editor's note
প্রিয়াঙ্কা গুলাটি মুম্বইয়ের সোফিয়া কলেজ ফর উইমেন থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক হয়েছেন। তিনি পারি এডুকেশনের সঙ্গে ইন্টার্নশিপ করার সময় এই প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন। বড়ো শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলি কতখানি বিপন্নতার মধ্যে নিজেদের অস্ত্বিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তিনি সেকথাই তুলে ধরতে চেয়েছেন।
অনুবাদ: অভিলাষ বিশ্বাস
অভিলাষ বিশ্বাস, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্র; লেখক ও অনুবাদক। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও ইতিহাস, ইউরোপীয় বাস্তবতাবাদ এবং লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে তিনি আগ্রহী।