
পায়ের চটিজোড়া সম্বল করেই পাথুরে রাস্তা বেয়ে, পথ দেখিয়ে হরিশ্চন্দ্রগড় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত দুর্গের কাছে পৌঁছে দেন অনুসূয়াবাই। বিগত এক দশক ধরে পশ্চিম ঘাট অঞ্চলে ৪,৭১০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই গড়ে তিনি আরোহণ করছেন। যবে তাঁর পরিবার পাহাড়ের মাথায় একটি খাবার গুমটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, সেই থেকেই তাঁর এই আরোহণ পর্ব শুরু হয়েছিল। এখানে পৌঁছানোর জন্য পাহাড় বেয়ে ওঠা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও পথই নেই। এই পথের চড়াই প্রায় ৬০-৮০ ডিগ্রি; ফলে মাত্র তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে তিন ঘণ্টা কাবার হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়লে অনুসূয়াবাইয়ের পরিবার পাহাড়ের পাদদেশে, সমতলভূমিতে একটি হোমস্টে গড়ে তোলে। পর্বতারোহণের ক্ষমতা আর উপর-নিচে ঘরোয়া খাবারের জোগান, এই দুয়ের জন্যই তিনি আজ পর্বতারোহী গোষ্ঠীর কাছে অতি পরিচিত নাম।



নৌভরি (চিরাচরিত মারাঠি নয় হাত শাড়ি) পরিহিত অনুসূয়াবাই জানালেন, “আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করে আমার জুতো লাগবে কিনা। কিন্তু চপ্পল পরে হাঁটতেই আমার সবচেয়ে সুবিধা হয়।” পাহাড়ের মাথায় তিনি যে খাবারের দোকানটি করেছেন, তারজন্য আনাজপাতি বওয়ার জন্য তিনি সাধারণত একজনকে সঙ্গে নেন। পাহাড়ের মাথায়, পুরোদস্তুর আহার পাওয়া যায় একমাত্র তাঁরই দোকানে, আর সেইজন্য ট্রেকারদের মধ্যে এটি এতটা জনপ্রিয়।
তাঁর এই জনপ্রিয় খাওয়ার দোকানটি, আসলে কাঠ আর মাটি দিয়ে বানানো একটি ঝুপড়ি মাত্র। প্রতিবছর ভারি বৃষ্টির পর এই নড়বড়ে কাঠামোটা নতুন করে বানাতে হয়। “আমরা জানি যে বর্ষা সব ধুয়েমুছে শেষ করে দেবে। তাই আগে থেকেই হোটেল (খাবারদোকান) বন্ধ করে দিই, যাতে আমাদের অতিথিদের কোনও বিপদআপদ না হয়,” বললেন অনুসূয়াবাই। নতুন করে দোকান গড়ে তুলতে সপ্তাহ দুয়েক লাগে।
হরিশ্চন্দ্রগড়ের পাদদেশে এই পরিবারের একটি হোমস্টে আছে যা পর্যটকদের পরিষেবা দেয়। আকোলা ব্লকের আহমেদনগর জেলায়, দুর্গ ও জঙ্গলের মাঝে, পাচনই গ্রামে অবস্থিত তাঁদের এই হোমস্টে।


পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় হরিশ্চন্দ্রগড়ের দুর্গটি নাকি ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল। “জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস অবধি এখানে পর্যটনের মরসুম, তখন প্রতি সপ্তাহান্তে আমাদের এখানে ১০০-১৫০ জন আহার করে। মানুষ আসে দুঃসাহসিক খেলায় (অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস) অংশ নিতে আর তারপর (বর্ষার পর) এখানকার ঝর্ণা দেখার পালা আসে,” জানালেন অনুসূয়াবাই। সপ্তাহান্তের পর্যটকদের তদারকি করতে তিনি হেঁটে উপরে উঠবেন। তিনি আরও বললেন, “মার্চ অবধি দুর্গ দেখার ভালো সময়। তারপর আর তেমন পর্যটক থাকে না।”
গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতেই খড়ের চালা আর গোবরে লেপা ইটের দেওয়াল। সবেধন নীলমণি বালবের আলোয় বদাড়দের মাটির বাড়ির রান্না আর ধোয়াধুই করার জায়গাটায় খানিক আলো দেয়। এই বাড়ির সিমেন্ট দিয়ে পাকা করা একটা অংশে অতিথিদের খাওয়াদাওয়া আর একরাত্তির কাটানোর জন্য দেওয়া হয়। দুপুরে ১৫০ টাকায় পেট ভরে রুটি সঙ্গে তরকারি, ভাত ডাল আর আচার পাওয়া যায়। প্রতি সপ্তাহে সব খরচপাতি বাদ দিয়ে পরিবারটির হাতে থাকে ৫,০০০-৮,০০০ টাকা।
পাহাড়ের পাদদেশের হোমস্টের গাড়ি রাখার জায়গায়, উৎসাহী ট্রেকারদের নিয়ে একটি বাস এসে থামলো, মাঝরাতের পর। যাত্রীদের অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য অনুসূয়াবাইয়ের বড়ো ছেলে, ভাস্কর ছুটে গেলেন। বাড়ি-তথা-হোটেলটিতে ঢোকার আগে কোথায় বাস দাঁড় করাবেন, কোথায় যাত্রীরা জুতো খুলে রাখবেন ইত্যাদি দেখিয়ে দিলেন ভাস্কর। তাঁর ছোটো ছেলের স্ত্রী আশা, পর্যটকদের জন্য মাদুর বিছিয়ে, জল আর গরম চা দেওয়ায় আইয়ের (অনুসূয়াবাইকে সবাই এই ডাকেই সম্বোধন করে) সঙ্গে কাজে হাত লাগান। ট্রেকাররা একটু জিরিয়ে নিলে, অনুসূয়ার স্বামী নাথু বদাড় তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন, তাঁদের হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকেন। ভাস্কর সকালের জলখাবার পরিবেশন করতে থাকেন। সাধারণত সকালে পোহা (চিঁড়ের পোলাও) দেওয়া হয়। ভাস্কর জানালেন, “২০১১-১২ সাল থেকে পর্যটকদের সংখ্যায় বৃদ্ধি হয়েছে।”
সপ্তাহান্ত পর্যটকদের খাবারদাবারের বন্দোবস্তে কেটে গেলেও সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলিতে বদাড় পরিবার নিজেদের ২.৫ একর জমিতে ধান চাষ করে। “আগে আমরা মাত্র চার-পাঁচ বস্তা চাল পেতাম। কিন্তু এখন বাড়তি শ্রম আর উচ্চফলনশীল ধানের বীজ ব্যবহার করে ২০-৩০ বস্তা চাল পাই। এর বেশিরভাগই লেগে যায় পর্যটকদের খাওয়াদাওয়ায়,” বললেন ৪০ বছর বয়সি ভাস্কর। বেঁচে থাকা চালটুকু তাঁরা রেখে দেন নিজেদের খোরাকির জন্য।


সপ্তাহান্তের অতিথিদের জন্য রসদের জোগান রাখতে অনুসূয়া আই প্রতি সোমবার আর শুক্রবার ছেলে, ভাস্করকে নিয়ে রাজপুর যান। পাচনইয়ের সবচেয়ে কাছের শহরটি হল রাজপুর, কিন্তু সেই অবধি পৌঁছানোর পথটি খানা-খন্দে ভরা। “দুটো জায়গার মধ্যে দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার হলেই বা? ওখানে পৌঁছাতে আমাদের দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়,” বললেন ভাস্কর।
পাচনই গ্রামে ১৫৫টি পরিবার ও ৭০০ মানুষের বাস। অথচ সেখানকার বাসিন্দাদের মতে, গ্রামে ভদ্রস্থ পৌরব্যবস্থা তো নেই-ই, গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে জরুরি রসদ পর্যন্ত সেখানে ঠিকমতো পৌঁছায় না। “আমাদের গ্রামে বহুদিন আগেই সরকারি উদ্যোগে খাদ্য বা রদস পৌঁছানো বন্ধ হয়ে গেছে,” জানালেন অনুসূয়া আই। অগত্যা গ্রামের মানুষ নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছেন। স্থানীয় কুয়োর জল যখন আর পান করার যোগ্য রইলো না, “আমরা, ভ্রমণে করতে আসা সব গাড়িগুলি থেকে খুব সামান্য পরিমাণ, এক-দুই টাকা করে সংগ্রহ করে পাইপ আর মোটর কিনে নিকটবর্তী একটা ঝোরার সঙ্গে যোগ করে দিয়েছি,” বললেন নাথু। সাধারণ শৌচাগারটিও সবেমাত্র তৈরি করেছে বনবিভাগ।
পার্শ্ববর্তী, কোথলে গ্রামেই জন্ম অনুসূয়াবাইয়ের। ১৬ বছর বয়সে নাথুর সঙ্গে বিয়ের পর তিনি পাচনাইয়ে তাঁর বাড়ি চলে আসেন। এক দশক পর পরিবারটি ভাঙতে শুরু করে, সদস্যদের কেউ কেউ বাড়তি সুযোগ সুবিধার আশায় শহরাঞ্চলে চলে যেতে থাকেন। “আই, আমাদের নিজেদের খেতে কাজ করার পাশাপাশি পড়শি গাঁ নারায়ণগাঁওয়েও চলে যেত খেতমজুরি করতে। সেখানে ১২ ঘণ্টা মজুরির কাজ করে ৪০-৫০ টাকা আয় হত,” খাবার দোকান খোলার পূর্ববর্তী তাঁদের জীবনের কথা প্রসঙ্গে ভাস্কর বলছিলেন।


যাঁরা পর্বতারোহণে আসেন, তাঁরা একথা বিলক্ষণ জানেন যে হরিশ্চন্দ্রগড়ের পথ কতখানি দুর্গম। খাড়াই পথ তো আছেই, আর আছে বড়ো বড়ো পাথরের চাঙর। উপরে ওঠার কোনও সিঁড়ি নেই; ছোটো ঝোরার নিচের পিছল পথ অবস্থাটাকে আরও সঙ্গীন করে তুলেছে। পথের খানিকটা অংশ বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের লটবহর নামিয়ে রেখে চার হাতপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠেন। আই অবশ্য পুরো পথটাই মাথায় বোঝা নিয়ে দিব্যি খাড়া হেঁটে উঠতে পারেন।
এই বছরের গোড়ায়, অনুসূয়াবাই, দুর্গের কোকানকাড়া চূড়া থেকে (১,৮০০ ফিট) নিচে নামেন দড়ি বেয়ে। তাঁর কথায়, “আমার বহুদিনের ইচ্ছা ছিল যে দড়ি বেয়ে নামব (র্যাপেল), কিন্তু বুড়ো মানুষের কথা কে আর শোনে!”


এই প্রতিবেদনের কাজে সহায়তার জন্য গণেশ গীধ ও ভাস্কর বদাড়কে শিক্ষার্থীরা ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
পারি’র হোমপেজ-এ ফিরতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
Editor's note
রুতুজা গাইধানি মুম্বইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের (স্বায়ত্তশাসিত), গণজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতার অন্তিম বর্ষে পাঠরত। শুভম রসাল ২০২১ সালে থানে জেলার সতীশ প্রধান জ্ঞানসাধনা কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন। তাঁদের কথায়, “এই প্রতিবেদন আমাদের সামনে এমন একটি জগতের দ্বার উন্মোচন করেছে, যেটির বিষয়ে আমরা জানতাম বটে, কিন্তু কোনওদিনই তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে পারিনি। [আমাদের প্রতিবেদনে] গ্রামবাসীরা তাঁদের সমস্যাগুলিকে সম্পূর্ণ নতুন আলোয় তুলে ধরেছেন, ফলে আমরাও সেগুলিকে অনুধাবন করতে পেরেছি।”
অনুবাদ: চিলকা
চিলকা কলকাতার বাসন্তী দেবী কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিশেষ ক্ষেত্রটি হল গণমাধ্যম ও সামাজিক লিঙ্গ।