
এই প্রতিবেদনটি আদতে বাংলাতেই লেখা হয়েছিল। সারা ভারত জুড়ে পারি এডুকেশন নিজ নিজ মাতৃভাষায় লিখতে ও সাংবাদিকতায় উৎসাহী অসংখ্য পড়ুয়া, গবেষক এবং শিক্ষাবিদদের সঙ্গে কাজ করছে।
“আগে সাধারণত শীতকাল এলে তবেই বুনতাম আমরা। সাত সকালে গাছের পাতাগুলো বেশ তরতাজা সাফসুতরো থাকে,” জানালেন দেবী মালিক, “গ্রীষ্মকালে অত্যধিক গরম আর ধুলোয় পাতাগুলো কেমন যেন কালচে-বাদামি হয়ে যায়, আমরা তাই সক্কাল সক্কাল গিয়ে পেড়ে আনি।”
চারিদিকে খেজুরপাতা সাজিয়ে মেঝের উপর বসেছিলেন তিনি, এই পাতাগুলি দিয়েই চাটাই বোনা হচ্ছিল। “আমাকে কেউই হাতে ধরে শেখায়নি। যা কিছু শেখার তা মা আর ঠাম্মাকে দেখে দেখেই শিখেছি,” আমাকে বললেন তিনি।


গেরস্থালির কাজে লাগে, এমন ছোট-বড়ো মাদুর বা চাটাই আজও বাড়িতে বসেই নারকেল ছোবড়ার সঙ্গে খেজুরপাতা বুনে তৈরি করেন ৬৫ বছর বয়সী দেবী মালিকের মতো মহিলা কারিগরেরা। সুন্দরবন থেকে খানিক দুরবর্তী কলকাতার পূর্বপ্রান্তে স্থিত জলাভূমি এলাকায় তাঁর বাস। নারকেল আর খেজুর গাছে ভরা সবুজ এক দুনিয়া। ১২,৫০০ হেক্টর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পুকুর, ডোবা ও বর্জ্যজলের ঝিলে ঢাকা এই বিস্তীর্ণ এলাকাটি মাছ-চাষের জন্য বিখ্যাত। – এই জলাভূমিটি একইসঙ্গে মাছ-চাষি, মৎস্যজীবী ও কৃষকদের ভিটেমাটি ও কর্মক্ষেত্র (বিশদে জানতে হলে পড়ুন: কলকাতা জলাভূমির এক মৎস্যজীবীর কথা)।
দেবী মালিক আমার ঠাকুমা, আপাতত সাঁইতলায় আমাদের বাড়িতে বসে বসে তাঁর চাটাই-বোনা দেখছি। আমার নাম স্বস্তিকা মালিক, আমি থাকি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায়। পরিবার বলতে ঠাকুরদা প্রেমানন্দ মালিক, বাবা কমল মালিক, মা অসীমা মালিক আর আমার ১০ বছর বয়সী বোন সুচিত্রা মালিক।
এককালে আমার ঠাম্মা-ঠাকুরদা ধান ও সবজি-চাষ করতেন, তবে এখন আর আগের মতো চাষের কাজ করতে পারেন না। স্থানীয় একটি আড়ত থেকে মাছ কিনে কলকাতায় গিয়ে বেচে আসেন আমার বাবা কমল মালিক, মাস গেলে হাজার সাতেক টাকা রোজগার হয়।


আদর করে ঠাকুমাকে ‘ঠাম্মা’ বলে ডাকি আমি, ৬৫ বছরের এই মানুষটি চাটাই ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজে পটু: কাঁথা, উলের জিনিসপত্র ইত্যাদি। তাঁর কাছ থেকে আমাদের গ্রামের অনেক মহিলা কাজ শিখেছেন।
যেদিন যেদিন আমি ঠাম্মার কাজে হাত লাগাই, সেদিন ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে পড়ি বড়সড় দেখে পাতা জোগাড় করে আনতে – একেকটা ৬-১২ হাত লম্বা, অর্থাৎ আমার দুইগুণ! একটা প্রমাণ আকারের চাটাই বুনতে এরকম প্রায় খান চল্লিশেক পাতা লাগে।
ঠাকুমা বলেন, “পাতাগুলো কেটেছেঁটে আবার করে শুকোতে দিই রোদে [ছাদে]। শুকনো পাতা দিয়ে মাদুর বুনি।”
ঠাম্মা কেমন করে পাতাগুলো দুভাগ করে চিরে দিচ্ছিলেন, মন দিয়ে সেটাই দেখছিলাম। এরপর ভাগদুটো একে একে দুমড়িয়ে বিনুনির ছকে উপর-নিচ করে জুড়ে দিলেন। চাটাই বানাতে যে পাটিগুলো লাগে, দেখতে দেখতে সেগুলো তৈরি হয়ে গেল, একেকটা আমার হাতের তালুর মতো চওড়া। তিনি বলেন যে ইয়াব্বড় একটা ছুঁচ আর মোটা সুতির সুতো দিয়ে এই পাটিগুলো জুড়তে হয়। কাজের শেষে খুচখাচ যা পাতা পড়ে থাকে, সেগুলো দিয়ে ঘর ঝাঁট দেওয়ার ঝাড়ু বানান ঠাকুমা।



ঠাম্মার কথায়: “খেজুরগাছ এখন কমে গেছে, তাই ভালো দেখে পাতা জোগাড় করাটা দিনকে দিন মুশকিল হয়ে উঠছে। এখানে আর আগের মতো বোনার কাজ হয় না।” খেজুর গাছের জন্য মন-খারাপ করা মানুষটির কাছ থেকে এটাও জানা গেল: “ওই একটা গাছের থেকেই হাজারটা কাজের জিনিস মেলে।” এই ‘হাজার একটা জিনিস’-এর মধ্যে সুগন্ধী ঝোলা গুড় অন্যতম, শীতকাল এলে খেজুর গাছের কাণ্ড থেকে নিঃসৃত রস দিয়ে যা বানানো হয়। তিনি বলেন, আগেকার দিনে নাকি সাঁইতলার সকালগুলো ম-ম করত টাটকা খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার গন্ধে, তবে এখন আর অতটাও দেখা মেলে না তার।
নারকেলের বাইরের দিকে থাকা জটাজুট দিয়ে বানানো হয় নারকেল ছোবড়া। এ দিয়ে ঘষামাজার বুরুশ, সুতো এবং নারকেল দড়ির মতো নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্র তৈরি হয়। চাটাই বোনা ছাড়াও শীতকাল এলে তোশক বানানোর কাজে নারকেল ছোবড়া ব্যবহার করেন ঠাকুমা। চাটাইগুলো বিভিন্ন কাজে লাগে, তবে সাধারণত ওর উপর ধান এবং মুসুর ও মুগের মতো ডালের দানা পেতে শুকোনো হয়, আমাদের গাঁয়ে এসবই খাওয়া হয়।
মাদুর ছাড়াও উল বুনে হরেক জিনিস বানাতে ওস্তাদ আমার ঠাম্মা, এই যেমন স্কার্ফ, ফুল-ফলের ঝুড়ির ঢাকনা, সোয়েটার, টুপি প্রভৃতি। কোনও কোনও দিন চাটাই-ফাটাই ছেড়ে হাতে তুলে নেন উলের কাঁটা। “নয়তো এককাঁড়ি পয়সা খসিয়ে কলকাতা গিয়ে কিনতে হত এসব [উলের তৈরি গরমজামা]। এগুলো পাওয়া যায় এমন কোনও বড়ো দোকান বা বাজার-হাট নেই আমাদের এদিকে,” তিনি যে কেন এসব বুনতে শুরু করেছিলেন, সেটাই বুঝিয়ে বলছিলেন।



ঠাম্মা বলেন যে স্থানীয় হস্তশিল্পের কোনও কদরই নাকি নেই, তা সে বোনার কাজ হোক বা সেলাই-ফোঁড়াইয়ের। এইজন্যই বোধহয় এসব মালপত্র আর গাঁয়ের দোকান-টোকানে রাখে না, কেবল কলকাতা থেকে আনানো গড়পড়তা জিনিসই মেলে এখানে।
তবে সাপ্তাহিক হাটে গেলে মাদুর বা চাটাই পাবেন, যদিও সেটা একেক হপ্তায় একেক জায়গায় বসে। এসব জিনিসের চাহিদা একদমই নেই। মোটে একজনই মহিলা আছেন যিনি এর-ওর দরজায় ঘুরে ঘুরে চাটাই সংগ্রহ করে হাটে গিয়ে বেচেন, তাও নামমাত্র মূল্যে।
ঠাম্মারা আট ভাইবোন ছিলেন। তিনি বলেন: “আমার মা-বাবা দুজনেই বাজারে মাছ বেচত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুড়িয়ে গেল মানুষ দুটো, তাই রোজ রোজ বাজারে যাওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল।” ঠাকুমার মা মঞ্জু পাঁজা যখন দেখলেন যে বাজারে গিয়ে খাটাখাটনি করা আর সইছে না, তখন বড়ো সন্তান ঠাম্মা বাধ্য হলেন এগিয়ে আসতে। “তখনকার দিনে মেয়েরা হাটে-বাজারে মাছ বেচলে কেউ কিচ্ছুটি বলত না। এখন পুরো উল্টো হয়ে গেছে, মেয়েদের আজ বাজারে যাওয়া বারণ,” জানালেন দেবী। ছোটবেলায় তিনি তাঁর বাবা প্রবীর পাঁজার সঙ্গে বাজারে গিয়ে সারাদিনের ধরা মাছটুকু বেচে আসতেন।
“মাছ-টাছ বেচে যা আয় হত, ওই দিয়েই পেট চালাতাম, তবে বড্ড কঠিন ছিল সময়টা,” নিদারুণ অনটনের সেই দিনগুলোর কথা মনে করে বললেন তিনি। জলাভূমিতে যত্রতত্র যাদের দেখা মিলত, সেই শাকপাতা, শাপলা ও কচু খেয়েই জীবনধারণ করত তাঁর পরিবার।

আমার ঠাকুরদা প্রেমানন্দর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর ঠাম্মা সোনারপুর ব্লকের খেয়াদহ ২ পঞ্চায়েতের রানাভুতিয়া গ্রাম ছেড়ে খেয়াদহ ১ পঞ্চায়েতের সাঁইতলায় গিয়ে বাসা বাঁধেন। সে আজ ৪০ বছর আগেকার কথা। তাঁর মনে পড়ে, এখানে আসার পর, “বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই আমার থেকে বোনার কাজ শিখতে চায়। বাড়িতে ব্যবহারের জন্য চাটাই, আসন, নানান সব জিনিস বুনতাম।” এই চাটাইগুলি তাঁরা পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি জুড়ে সেলাই করে নিজের হাতে বানাতেন।
ঠাম্মা আরও বলেন: “ওই আসনগুলোর গায়ে কাঁথা স্টিচ দিয়ে নকশা তুলতাম। কখনও বা রংচঙে করার জন্য পুরোনো কোনও শাড়ির পাড়ও জুড়ে দিতাম।” ঠাকুমা আজও ছোটো আসন আর নকশাদার রুমাল বানান।
“লোকে আমার কারিগরির হাত দেখে তাজ্জব বনে যেত, কিনতেও চাইত [যা কিছু তৈরি করতাম], আমি কিন্তু কক্ষনো টাকাপয়সা চাইনি,” নিজের শিল্পকর্মটিকে কখনও ব্যবসা হিসেবে দেখেননি, একথা বেশ স্পষ্ট হয়ে যায় তাঁর কথায়। তবে হ্যাঁ, কালেভদ্রে হলেও যে-কটা জিনিস বিক্রি হত, তা দিয়ে ঘরখরচের সমস্যাটা অন্তত কিছুটা হলেও মিটত বটে।
ঠাম্মার দৃঢ় বিশ্বাস, এই কাজ শিখলে উপকারে তো লাগবেই, উপরন্তু কারিগরির ধারাটাও বেঁচে থাকবে।
দ্য ডিসাপিয়ারিং ডায়ালগ কালেক্টিভ (ডিডি) নামক সংগঠনটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং তাঁদের মধ্যে থেকে কাজ করে। কথোপকথন যাতে শুরু করা যায়, যাতে নিত্যনতুন আলোচনা উঠে আসে এবং বিবিধ বাধাবিপত্তি যাতে টপকে যাওয়া যায়, সেজন্য শিল্প ও সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসেবে তুলে নিয়েছে ডিডি। বিদ্যমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশের সংরক্ষণে সহায়তা তথা উত্তরোত্তর তাকে সমৃদ্ধ করে তোলাটাই তাদের মূল লক্ষ্য।
পিপলস্ আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়ার সহায়তায় লিখিত এই প্রতিবেদনটি আইএফএর ছত্রছায়ায় আর্কাইভস্ অ্যান্ড মিউজিয়াম প্রোগ্রামের ছত্রছায়ায় সংকলিত জল-আ-ভূমির গল্প ও কথা | স্টোরিজ অফ দ্য ওয়েটল্যান্ড নামক সংকলনটির একাংশ। নয়াদিল্লির গ্যোটে ইন্সটিটিউট/ম্যাক্স ম্যুলার ভবনের আংশিক সাহায্য না পেলে এটি সম্ভবপর হয়ে উঠত না।
Editor's note
স্বস্তিকা মালিক পশ্চিমবঙ্গের খেয়াদহ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ঠাকুমার কাছ থেকে হাতের কাজে তালিম নিতে সবিশেষ উৎসাহী সে। তার কাথায়, "ঠাম্মার কারিগরির সঙ্গে প্রকৃতি এবং আমার আশপাশের দুনিয়ার যে নাড়ির যোগ আছে, সেটা তুলে ধরতে পেরে বেশ ভাল লাগছে।"অনুবাদ: জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস)
জশুয়া বোধিনেত্র (শুভঙ্কর দাস) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল করেছেন। বর্তমানে অনুবাদ সহায়ক হিসেবে জশুয়া পারি'র সঙ্গে কর্মরত। কবি, শিল্পলেখক, শিল্প সমালোচক তথা সমাজ কর্মী ইত্যাদি নানান ভূমিকায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ।