
নানকমত্তা বাজার এলাকায় বাওলি সাহেব পর্যটন কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করানো বিজলি হালদারের ঠেলাগাড়িতে থরে থরে সাজানো রয়েছে প্যাকেট। কোনওটায় চিপস্, বিস্কুট, তো কোনওটায় নুন দেওয়া চিনেবাদাম, অথবা নিমকি। পাঁচ বছর ধরে এখানে আসতে আসতে বিজলি বুঝে গেছেন, এলে কিছু না কিছু বিক্রি হবেই।
ষাট পেরোনো বিজলির শরীরটা মাঝেমধ্যেই বিগড়োয়। তবুও ফি সকালে ঠেলা নিয়ে তিনি ঠিক হাজির হয়ে যান উত্তরাখণ্ডের এই মফস্বল বাজারে। প্রতিদিনই এখানে ভিড় জমান অসংখ্য মানুষ, যার অন্যতম কারণ নন্দোর ও দেওহা নদীর বাঁধ এবং নানকমত্তার গুরুদ্বারা — যা শিখ সম্প্রদায়ের একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র।
চার বছর আগে, পেটে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে গুরু রামদাস হাসপাতালে ভর্তি হন বিজলি – জানা যায় যে তাঁর জরায়ুতে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। ডাক্তারদের পরামর্শে জরায়ু বাদ দেওয়ার অস্ত্রোপচার (হিস্টেরেক্টমি) করাতে হয়, খরচ পড়ে প্রায় ১২,০০০ টাকা। এর পরের দুই মাস কোনও কামকাজ করতে পারেননি তিনি।
স্বামী বীরেন্দ্র হালদার, ৬৫, ও মেয়ে সীমার পুত্র তাঁদের পনেরো বছরের নাতি নবীনকে নিয়ে বিজলির সংসার। পরিবারটির বাস উধম সিং নগর জেলার অন্তর্গত এই শহরের বাঙালি কলোনিতে। এই কলোনির প্রায় অধিকাংশ মানুষই দিনমজুরি করে পেট চালা।
অস্ত্রোপচারের চার বছর বাদেও বিজলির পেটের যন্ত্রণা কমেনি। ধীর গলায় বললেন, “মাঝেমধ্যেই যন্ত্রণাটা ফিরে আসে। কাজ করতে খুব অসুবিধা হয়।” কিন্তু আবারও ডাক্তার দেখানোর মতো সামর্থ্য নেই এই দিনমজুর পরিবারটির। তাই সমস্ত ব্যথা সয়েই কাজ করে যেতে বাধ্য হন বিজলি। সওয়াল করলেন: “অসুবিধা হয় বটে, কিন্তু যদি কাজ না করি, পয়সা আসবে কোত্থেকে?”


বাঁদিকে: বিজলি ও তাঁর নাতি নবীন — নানকমত্তার ট্যুরিস্ট স্পটের কাছে, তাঁদের ঠেলাগাড়ির সামনে। ছবি: রিয়া চন্দ। ডানদিকে: বীরেন্দ্র পেশায় একজন কামার, জীবন ধারণের জন্য কাস্তে তৈরি করেন। ছবি: প্রকাশ চন্দ
আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি পরিবার দীর্ঘকালীন (প্রাথমিক পরবর্তী) চিকিৎসা ও হাসপাতালে ভর্তি জন্য বছরে ৫ লাখ টাকা অবধি স্বাস্থ্য বিমা পেতে পারে।
কিন্তু বিজলি বা তাঁর স্বামী, দুজনের কেউই এই প্রকল্পের কথা জানতেন না। ফলত, চিকিৎসার সমস্ত খরচ তাঁদের নিজেদেরকেই বহন করতে হয়েছিল। বিজলি বললেন, “যেটুকু টাকাপয়সা জমিয়ে রেখেছিলাম, পুরোটা এই চিকিৎসাতেই খরচ হয়ে গেল।”
বাড়ির সব কাজ সেরে, সকাল আটটার মধ্যেই তড়িঘড়ি ঠেলা সাজিয়ে ফেলেন বিজলি।
বাড়ি থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূর সিতারগঞ্জ প্রধান মার্কেট থেকে ৮০ টাকা প্রতি কিলোয় বাদাম কিনে এনে ১২০ টাকা কিলোয় বিক্রি করেন তিনি। বাদবাকি বিস্কুট, চিপস্, নিমকি আনতে যেতে হয় নানকমত্তা থেকে ৪০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কিছা বাজারে। সেখান একসাথে অনেকগুলো প্যাকেট কেনেন বিজলি।


বিজলির ঠেলায় চিনেবাদামও থাকে। এগুলো কিনতে তাঁকে যেতে হয় ১৩ কিলোমিটার দূর সিতারগঞ্জ বাজারে। ছবি: রিয়া চন্দ
গড়ে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয় তাঁর। দুজনের আয় মিলিয়ে, তার মধ্যে থেকেই বাদাম ভাজার জন্য কাঠ কেনা বা সংসার চালানো — সবকিছুই করতে হয় বিজলি আর বীরেন্দ্রকে।
বীরেন্দ্র বাড়িতে থেকে কাস্তে শান দেন – তৈরিও করেন। এর কৌশল তিনি শিখেছিলেন নানকমত্তা বাজারের কামারদের কাছে।
“আজকাল তো সবাই ফসল তুলতে কম্বাইন হারভেস্টার আর অন্যান্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিই ব্যবহার করে। তাই কাস্তের চাহিদা পড়ে গেছে,” বীরেন্দ্র বলছিলেন। এর ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বীরেন্দ্রর মতো বহু দক্ষ কারিগরের জীবিকা।
কোভিড-১৯ অতিমারির পর, বীরেন্দ্র তাঁর দোকানটি সরিয়ে এনেছেন বিজলির ঠেলাগাড়ির পাশে। এখন বিজলিও সময় পেলে কাস্তে শান দিয়ে তাঁকে সাহায্য করেন।




নানকমত্তায় আসার আগে বিজলি আর বীরেন্দ্র থাকতেন পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায়। সেখানে দিনমজুরির কাজ করতেন ওঁরা। ২২ বছর বয়সে বিজলির বিয়ে হয় বীরেন্দ্রর সঙ্গে – এরপরই তাঁরা উত্তরাখণ্ডে চলে আসেন এবং বসবাস শুরু করেন এখানকার বাঙালি কলোনিতে।
পুরোনো কথা মনে করে বিজলি হেসে ফেললেন, “বিয়ের পর ঘুরতে ঘুরতে আমরা নানকমত্তায় চলে আসি। আমার মামা থাকতেন এখানে – তাই আমরাও চলে এলাম।”
এখানে এসে প্রথম প্রথম তাঁরা খেতমজুরের কাজ করতেন। বিজলির কথায়: “আগে তো আমরা অন্যের খেতে কাজ করতাম। গুরুদ্বারার জমিতে ধান আর গম ফলাতাম। তার বদলে ওই ২৪-২৫ টাকার মতো পেতাম রোজ।”
পাঁচটি মেয়ে আছে বিজলি আর বীরেন্দ্রর – বীণা, সীমা, শীলা, স্মৃতি ও ইতি। পরিবারটি বড়ো হওয়ার সাথে সাথে টান পড়ে রোজগারে, তাই আয় বাড়াতে কাস্তে নির্মাণের কাজ শুরু করেন বীরেন্দ্র।
নিজেরা কোনওদিনও ইস্কুলে যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায়, দুজনেই চেয়েছিলেন তাঁদের মেয়েরা লেখাপড়া শিখুক। “ওরা ক্লাস ৪-৫ অবধি নানকমত্তার সিদ্ধা নবদিয়া গ্রামের সরকারি ইস্কুলে পড়েছে। তারপর ইস্কুলের মাইনে আর সংসারের খাইখরচা একসাথে সামলানোর মতো সামর্থ্য ছিল না। তাই ওদের আর ইস্কুলে পাঠাতে পারলাম না,” আক্ষেপের সুর শোনা যায় দুজনের গলায়।


মাস গেলে রেশনে ১৫ কেজি চাল আর গম পান ঠিকই, কিন্তু ওটুকু দিয়ে পুরো পরিবারের মাসিক চাহিদা মেটে না। রেশন শেষ হয়ে গেলে বাজার থেকে ২৫ টাকা কিলোয় এক কেজি চাল আর ১৬০ টাকায় ৫ কেজি আটা কিনতে হয়।
বীরেন্দ্র জানালেন, “পাঁচ মেয়ে যদি একসাথে কোনওদিন বাড়ি আসে, ১৫ কেজি রেশন তো চোখের পলকে ফুরিয়ে যাবে।”
অতিমারির সময় ঘরবন্দি দশা তাঁদের জীবনকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। “করোনার সময় তো কাজে বেরোতেই পারতাম না। ঘরে পড়ে থাকতে হত,” বললেন বিজলি। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনায় খানিক খাদ্যশস্য পেতেন বটে, কিন্তু সংসারের অন্যান্য খরচা চালানো তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল।
পারি’র হোমপেজ-এ ফিরতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
Editor's note
রিয়া চন্দ নানকমত্তা পাবলিক স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। তাদের স্কুলে পারির কর্মশালায় অংশগ্রহণ করার পর সে বিজলি হালদারের কথা তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়।
রিয়া জানিয়েছে, “বিজলির কথা শুনতে শুনতে আমি উপলব্ধি করি যে আমাদের সমাজের তাঁর মতো বহু মানুষ সরকারি প্রকল্প বা সুবিধাগুলোর কথা না জানার ফলে, সেসব থেকে বঞ্চিতই থেকে যান।”
অনুবাদ: অংশুপর্ণা মুস্তাফী
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী অংশুপর্ণা মুস্তাফী। গল্পকথন পদ্ধতি, ভ্রমণকথা, দেশভাগচর্চা, মানবী বিদ্যাচর্চার মতো বিষয়গুলিতে তাঁর আগ্রহ রয়েছে।